ARTICLES

বাঙালীর গ্রীকচর্চা কতটা প্রাসঙ্গিক

অনিরুদ্ধ ভট্টাচার্য্য

গ্রীকসংস্কৃতির সঙ্গে আমাদের ভারতীয়দের যোগ দু’হাজার বছরেরও পুরোনো। এই সম্পর্কের শুরু হয়েছিল সম্ভবত আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের সময় থেকে, অর্থাৎ যীশুখ্রীষ্টের জন্মের তিনশো সাতাশ বছর আগে। সেই সম্পর্কেরই অন্যতম পরিণাম যে ‘গান্ধার শিল্প’ তা সকলেরই জানা। গ্রীক ভাষার সঙ্গেও যে তখন থেকেই আমাদের পরিচয়ের শুরু এবিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সুনীতি চাটুজ্জে (১৮৯০-১৯৭০) মশাইয়ের কৃপায় আমরা স্কুলে পড়বার সময়েই মেনে নিয়েছিলাম যে মূল্য অর্থে আমাদের বাংলা ‘দাম’ কথাটির মূল উৎস গ্রীক ‘দ্রাখমা’ শব্দ বা সংস্কৃতে প্রচলিত ‘হোরা’ শব্দটিও মূলত গ্রীক শব্দ। এই সম্পর্কের আর একটি সুফল মেগাস্থিনিসের ‘ইন্দিকা’, যা কোনো বিদেশীর লেখা ভারত-সংক্রান্ত প্রাচীনতম গ্রন্থ। আমাদের দেশের ইতিহাসের অনেক উপকরণ ছিল এই পুস্তিকায়।

অবশ্য একথা ঠিক যে গ্রীক সংস্কৃতির সঙ্গে আমাদের এই সংযোগ তেমন গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। অত্যন্ত প্রাচীন ও বিস্ময়কর রূপে উন্নত গ্রীক সভ্যতা ও সংস্কৃতির সঙ্গে দীর্ঘ ও নিবিড় সংযোগ স্থাপিত হলে তা আমাদের লাভজনকই হতো। কিন্তু দু’হাজার বছরেরও আগের সেই সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। পরবর্তীকালে আরবী অনুবাদের মধ্য দিয়ে গ্রীক দর্শন, বিজ্ঞান ইত্যাদির কিছু চর্চা মাদ্রাসাগুলিতে চলে আসছিল, যদিও বেশিরভাগ লোকের সঙ্গে তার কোনো যোগ ছিল না।

দ্বিতীয় পর্যায়ে গ্রীক ভাষা ও সাহিত্যের সঙ্গে বাঙালীর সম্পর্কের সূচনা হয় ভারতবর্ষে ইংরেজ আগমনের পর। শোনা যায় রামমোহন (১৭৭২-১৮৩৩) হিব্রু ও গ্রীক ভাষা শিখেছিলেন। একথা যদি সত্য হয় তাহলে আধুনিক ভারতবর্ষে রামমোহনই প্রথম গ্রীক-ভাষাবিদ। তবে রামমোহন যদি গ্রীক ভাষা শিখেও থাকেন, তিনি তা শিখেছিলেন খ্রিষ্টান ধর্মযাজকদের সঙ্গে বিতর্কের প্রস্তুতিরূপে মূল বাইবেল পড়বার জন্য, গ্রীক সাহিত্যের রসাস্বাদনের জন্য নয়। গ্রীক সাহিত্যের প্রথম রসজ্ঞ পাঠক মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩)। খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণের জন্য তিনি হিন্দু কলেজ ত্যাগ করতে বাধ্য হন। এই ঘটনাটি তাঁর পরে শাপে বর হয়ে দাঁড়ায়। কারণ এরপরে তিনি বিশপ কলেজে ভর্তি হতে বাধ্য হন। তিনি শুধু হোমারের মহাকাব্য বা আরিস্টটলের কাব্যতত্ত্ব পড়েই ক্ষান্ত হননি, গ্রীক মহাকাব্যের আদর্শে ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ রচনা করেছেন। তাঁর ‘হেক্টরবধ’-ও ‘ইলিয়াড’ পাঠের প্রত্যক্ষ ফল। মধুসূদনের পরেও অনেক বাঙালী গ্রীক ভাষার চর্চা করেছেন। অরবিন্দ ঘোষ, তাঁর সহোদর কবি মনোমোহন ঘোষ ও বহুভাষাবিদ হরিনাথ দে তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য। কিন্তু তাঁদের এই গ্রীক ভাষা চর্চার ফলভোগী আমরা হতে পারিনি।

মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বল্প সংখ্যক অধ্যাপকদের মধ্যেই এ চর্চা সীমাবদ্ধ রয়েছে। অথচ গ্রীক ইতিহাস, দর্শন এবং সম্প্রতি অনুবাদের মাধ্যমে ধ্রুপদী গ্রীক সাহিত্যের নির্বাচিত অংশ ভারতবর্ষের বহু বিশ্ববিদ্যালয়েই কমবেশি পড়ানো হয়। কিন্তু মজার ব্যাপার এই যে গ্রীক ভাষা চর্চার সুযোগ এখানে নেই বললেই চলে, যদিও এখানে চাইনিজ বা স্প্যানিশ ভাষা শেখার ব্যবস্থা রয়েছে। হোমার, সফোক্লিস বা সক্রেটিস, প্লেটো, আরিস্টটল বা হেরোডটাস, থুকিডাইডিস প্রভৃতি নাম শিক্ষিত ব্যক্তি মাত্রই জানেন। এমনকি স্কুলের ছেলেরাও জানে মেগাস্থিনিস, পিথাগোরাস, আর্কিমিডিস, ইউক্লিড ও আরিস্টটলের নাম। কারণ, তাদের জানতে হয় মেগাস্থিনিস ভারতবর্ষ সম্পর্কে কী বলেছিলেন; শিখতে হয় পিথাগোরাসের উপপাদ্য এবং আর্কিমিডিসের সূত্র। আর ইউক্লিডকে বাদ দিয়ে জ্যামিতির পঠনপাঠন তো অসম্ভব, যেমন অসম্ভব অবরোহ তর্কবিদ্যার জনক আরিস্টটলকে বাদ দিয়ে তর্কবিদ্যার পাঠ। গ্রীক দেশীয় ঈশপের নীতি-শিক্ষামূলক পশুপাখির গল্পগুলি সেই কবেই বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১) মশাই ‘কথামলা’ নাম দিয়ে বাংলাদেশের ঘরে ঘরে ছেলেমেয়েদের হাতে পৌঁছে দিয়েছিলেন। এমনকি এই আধুনিক কালে কলকাতা শহরে বসে আমরা দেখেছি সফোক্লিসের ‘রাজা অয়দিপাউস’-এর মতো গ্রীক নাটকের প্রযোজনা। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে আমাদের কখনো মনে হয়নি যে এইসব মনীষীরা কি লিখেছেন তা তাঁদের ভাষাতে একটু পড়ে দেখি। হয়তো এজন্যও সুদীর্ঘ বিদেশী শাসনই দায়ী। ইংরেজিতে গ্রীক লেখকদের রচনার অনুবাদ সহজলভ্য হওয়াতে আমরা আর কেউ মূল-ভাষা শিখতে আগ্রহ বোধ করিনি। আমরা তাই গ্রীক সাহিত্য চর্চার ব্যাপারে দুধের স্বাদ ঘোলে মিটিয়েছি বা পরের মুখে ঝাল খেয়েছি। কিন্তু একথা অনস্বীকার্য যে গ্রীক ভাষাকে বাদ দিয়ে আমাদের পক্ষে— শুধু আমাদের পক্ষেই বা কেন, পৃথিবীর কোনো দেশের কিংবা সভ্য জাতির পক্ষেই চলা সম্ভব নয়। একটু উঁচু শ্রেণীর ছাত্রদের বৃত্তের পরিধি সংক্রান্ত প্রশ্নে শিখতে হয় গ্রীক বর্ণমালার π (পাই) বর্ণটি, ত্রিকোণমিতির পাঠ নিতে গিয়ে শিখতে হয় θ (থিটা) বর্ণটি, আরও নানা প্রসঙ্গে শিখতে হয় α, β, γ (আলফা, বিটা, গামা) ইত্যাদি বর্ণগুলি। পরিসংখ্যানের ছাত্রদের কাছে Σ (সিগমা) এই গ্রীক বর্ণটি অপরিহার্য। ‘গামা’ রশ্মির নামকরণ গ্রীক বর্ণমালার তৃতীয় বর্ণটি দিয়ে। আর পৃথিবী-বিখ্যাত অমেগা ঘড়ির নামকরণে রয়েছে শেষ বর্ণটি (Ω)। আমরা যদি জানি গ্রীক বর্ণমালার প্রথম দুটি বর্ণ আলফা (α) ও বিটা (β), তবে আর বুঝতে অসুবিধা হয় না, কেন বর্ণমালাকে ইংরেজিতে ‘আলফাবেট’ বলা হয়।

এমনকি যে ইংরেজি ভাষা না জানলে কোনো ভারতীয় কার্যত শিক্ষিত বলে গণ্য হন না, যে ইংরেজি ভাষা শিখবার ব্যর্থ চেষ্টায় আমাদের অনেকের বাল্য ও কৈশোরের প্রায় সমস্ত উদ্যম ও শ্রম ব্যয়িত হয় সেই ইংরেজি ভাষাই কী গ্রীক ভাষার কাছে কম ঋণী? ইংরেজি ভাষাতত্ত্ব বা ইংরেজি ভাষাতত্ত্ব সংক্রান্ত কোনো বই কিংবা ব্যুৎপত্তিযুক্ত ইংরেজি ভাষার যে কোনো অভিধান তার সাক্ষ্য দেবে। ইংরেজি ভাষায় বহুল ব্যবহৃত আইডিয়া, জেনেসিস, ক্রাইটেরিয়ান, ক্লাইম্যাক্স, ক্রাইসিস, অ্যানালিসিস, বেসিস, ডায়াগনোসিস, কমা, সিনোপসিস, ড্রামা, ট্র্যাজেডি, কমেডি, ক্যারেকটার, অরকেস্ট্রা, কোরাস, ইকো, সিন, সিনেমা, টেলিফোন, টেলিভিশন, সাইকি ইত্যাদি অজস্র শব্দের মূল উৎস গ্রীক ভাষা। এরা কেউ সরাসরি ইংরেজিতে এসেছে, কেউ অন্য ভাষার মধ্য দিয়ে। কেউ অবিকৃত রূপে, কেউ বা ঈষৎ বিকৃত হয়ে। তাই গ্রীক ভাষা চর্চা যে আমাদের ইংরেজি ভাষায় অধিকারকে আরও দৃঢ় করবে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

অলিম্পিক-ক্রীড়া বিশ্বসভ্যতায় গ্রিকদের দান। আমরা পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নাগরিক। আমাদের একথা ভুলে যাওয়া অনুচিত যে শুধু ‘ডেমোক্র্যাসি’ শব্দটিই নয়, যে গণতন্ত্র নিয়ে আমাদের এত বড়াই সেই গণতন্ত্র ও নির্বাচনের ধারণাও এজগৎকে গ্রীকরাই দিয়েছে। উদাহরণ বাড়িয়ে লাভ নেই।

মোটের উপর আমরা দেখতে পাচ্ছি যে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চায় ও নানা কারণে ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক সমগ্র বিশ্বকে গ্রিকদের দ্বারস্থ হতে হয়েছে। অতএব বলা যেতে পারে যে গ্রীক ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চা আমাদের পক্ষে খুব অবান্তর বা অপ্রাসঙ্গিক কোনো বিষয় নয়।
——
[ ‘প্রমথ’, পঞ্চম বর্ষ, মে ১৯৯০ সংখ্যায় প্রকাশিত। সম্পাদক ও প্রকাশক— অসিত চক্রবর্তী (১৯৩৫-২০০৩), প্রতিষ্ঠাতা— গ্রীক ক্লাব কিক্লস, কলকাতা। মূল বানান অপরিবর্তিত। ]